৪১. দুর্য্যোধনের সহিত অর্জ্জুনের যুদ্ধও কুরুসৈন্যের মোহপ্রাপ্তিঅচেতন দেখি রথ ফিরায় সারথি।ভীষ্ম ভঙ্গ দেখি ক্রোধে ধায় কুরুপতি।।গজেন্দ্র চড়িয়া যেন ইন্দ্র দেবরাজ।চতুর্দ্দিকে বেড়ি ধায় ক্ষত্রিয়-সমাজ।।ঊনশত সহোদর বেষ্টিত চৌপাশে।সবে অস্ত্র শস্ত্র পার্থ উপরে বরিষে।।হাসিয়া অর্জ্জুন বীর করিয়া সন্ধান।দুর্য্যোধনে প্রহার করেন দশ বাণ।।কাটিয়া পাড়েন তার ভয়ঙ্কর ধনু।কবচ কাটেন দুই, ছয় বাণে তণু।।প্রহার করিল ভল্ল গজেন্দ্র-মস্তকে।বজ্রাঘাতে যেন গিরিশৃঙ্গ শত মথে।।পৃথিবীতে দন্ত দিয়া পড়িল বারণ।লাফ দিয়া ভূমিতলৈ পড়ে দুর্য্যোধন।।দুর্য্যোধন ভঙ্গ দেখি যত সহোদর।পাছু নাহি চাহে সবে পলায় সত্বর।।পাছু থাকি ডাকে ঘন পার্থ ইন্দ্রসুত।কি কর্ম্ম করিস্ লোকে শুনিতে অদ্ভুত।।সসৈন্যে পলাস্ সঙ্গে শত সহোদর।বলাও ধরণী-মাঝে তুমি দণ্ডধর।।যুধিষ্ঠির নৃপতির আজ্ঞাকারী আমি।মোরে দেখি পলাইস্ হয়ে ক্ষিতিস্বামী।।সসৈন্য পলায়ে যাস্ শৃগালের প্রায়।এই মুখে রাজ্যভোগ ইচ্ছ হস্তিনায়।।এতেক সহায় তোর গেল কোথাকারে।মারিলে এখন আমি কে রাখিতে পারে।।শত্রু নিজ বশ হলে, কে ছাড়ে মারিতে।যদি মারি কোথা পথ পাবি পলাইতে।।ছাড়িলাম লয়ে যাহ নির্লজ্জ জীবন।ব্যর্থ নাম ধর তুমি, মানী দুর্য্যোধন।।পলাইলি মম ভয়ে শৃগালের প্রায়।এই মুখে গবী নিতে আসিলি হেথায়।।পলায়িত জনে আমি না মারি কখন।ভীমসেন হৈলে তোর নাশিত জীবন।।অর্জ্জুনের এইরূপ কটুবাক্য শুনি।ক্রোধে নেউটিল দুর্য্যোধন মহামানী।।লাঙ্গুলে মারিলে যথা নেউটে ভুজঙ্গ।অঙ্কুশ কর্ষণে যথা নেউটে মাতঙ্গ।।নেউটিল দুর্য্যোধন, দেখি বীরগণ।চতুর্দ্দিকে ধেয়ে পুনঃ আসে সর্ব্বজন।।ভীষ্ম দ্রোণ কৃপা অশ্বত্থামা শাল্ব কর্ণ।দুঃশাসন মহাবল দুঃসহ বিকর্ণ।।সহস্র সহ্স্র রথী বেড়িল অর্জ্জুনে।চতুর্দ্দিকে নানা অস্ত্র বর্ষে ক্ষণে ক্ষণে।।মুষল মুদগর জাঠি শূল ভিন্দিপাল।আকাশ ছাইয়া সবে করে শরজাল।।হাসিয়া অর্জ্জুন এড়িলেন দিব্য বাণ।সবাকার দিব্য অস্ত্র কৈল খান খান।।গজেন্দ্র মণ্ডলে যেন বিহরে কেশরী।দানবগণের মধ্যে যেন বজ্রধারী।।সিন্ধু-জল মধ্যে যেন পর্ব্বত মন্দর।কুরুবল মথে পার্থ হয়ে একেশ্বর।।কখন দক্ষিণ হস্তে কভু বাম করে।ভৈরব মূরতি দেখি সংগ্রাম ভিতরে।।গাণ্ডীবের মূর্ত্তি অস্ত্র বিনা নাহি দেখি।লক্ষ লক্ষ অস্ত্র মারে দিন কার ঢাকি।।পড়িল অনেক সৈন্য হয় রথ গজ।পৃথিবী আচ্ছাদি পড়ে ছত্র রথধ্বজ।।তথাপিহ কুরুকুল যুদ্ধ না ছাড়িল।লক্ষপুর করি একা অর্জ্জুনে বেড়িল।।অর্জ্জুনের মনে এই চিন্তা উপজিল।জীয়ন্তে কৌরবগণ যুদ্ধ না ছাড়িল।।পরকার্য্যে জ্ঞাতিবধ করিলে বহুত।না জানি কি কহিবেন শুনি ধর্ম্মসুত।।ছাড়ি গেলে, কৌরব কহিবে পলাইল।কি উপায় করি, ইহা সমস্যা হইল।।তবে ইন্দ্রদত্ত অস্ত্র হইল স্মরণ।সম্মোহন নামে অস্ত্র মাহে রিপুগণ।।মন্ত্রে অভিষেকি পার্থ মারিলেন বাণ।মোহ গেল কুরুগণ, নাহি কার জ্ঞান।।রথে রথী পড়ে, অশ্বে পড়ে আসোয়ার।গজেতে মাহুত পড়ে, নিদ্রিত আকার।।সর্ব্বসৈন্য মোহপ্রাপ্ত, দেখিয়া অর্জ্জুন।উত্তরার বাক্য মনে হইল স্মরণ।।উত্তরে বলেন তবে ইন্দ্রের নন্দন।তব ভগ্নী মাগিয়াছে পুত্তলী বসন।।অনিহ সবার বস্ত্র মস্তক হইতে।যার যার চিত্র বস্ত্র লয় তব চিতে।।ভীষ্ম দ্রোণ দোঁহার না দিবে অঙ্গে কর।আর সবাকার বস্ত্র আনহ উত্তর।।সবে মুগ্ধ হইয়াছে, নাহি তব ভয়।যথাসুখে আন গিয়া, যাহা মনে লয়।।পার্থের বচন শুনি উত্তর নামিল।উত্তম উষ্ণীষ উত্তর বাছিয়া লৈল।।দুর্য্যোধন কর্ণ দুঃশাসন আদি করি।মুকুট করিয়া দূর কেশ মুক্ত করি।।রথিগণে বসাইল গজের উপরে।রথের উপরে বসাইল আসোয়ারে।।এমত উত্তর করি বহু বহু জন।পুনরপি উঠে রথে লইয়া বসন।।পার্থের অদ্ভুত কর্ম্ম দেখি দেবগণ।সুগন্ধি কুসুম বৃষ্টি করে সেইক্ষণ।।অপূর্ব্ব হইল শোভা ধরণী-মণ্ডলে।বিচিত্র কানন যেন বসন্তের কালে।।পড়িল অনেক সৈন্য, লিখনে না যায়।জীয়ন্তে আছিল যেই, সেও মৃতপ্রায়।।ভয়ঙ্কর হৈল ভূমি, দেখি লাগে ভয়।রক্ত মাংসাহারী ধায় সানন্দ হৃদয়।।শৃগাল কুক্কুরগণ করে কোলাহল।গৃধিনী শকুনি কাক ছাইল সকল।।শোণিতে বহয়ে নদী, অতি বেগবতী।হয় রথ পদাতিক ভাসে মত্ত হাতী।।নাচয়ে কবন্ধগণ ধনুঃশর হাতে।যোগিনী পিশাচ ভূত প্রেতগণ সাথে।।মহাভারতের কথা অমৃত-অর্ণব।বিরাটপর্ব্বে অজ্ঞাতে বঞ্চিল পাণ্ডব।।গবী-হরণ কাহিনী সুধাসিন্ধু মত।শ্রবণে ঘুচয়ে তার পাপ তাপ যত।।গো-রক্ষায় ধনঞ্জয়ের রণ অভিসার।রণক্ষেত্রে চামুণ্ডা হইল আগুসার।।৪২. রণভূমে চামুণ্ডার আগমনআইল চামুণ্ডা, করে খর খাণ্ডা,গলে দোলে মুণ্ডমালা।লহ লহ জিহ্বা, বিদ্যুতের প্রভা,ঘন বদন করালা।।বিকট দশানা, শোণিত রসনা,ভৈরবী ভৈরব ডাকে।সঙ্গে শত শিবা, অতিশয় শোভা,ভূত প্রেতগণ থাকে।।সবার কুণ্ডল, মিহির কুণ্ডল,দোলয়ে যুগল গণ্ডে।দনুজ-দলনী, সক্রোধে চাহনি,গলে নরমালা মুণ্ডে।।যুগ্ম পয়োধর, জিনিয়া ভূধর,দশ অষ্ট চতুর্ভূজা।।অধরে বারুণী, সদা মুক্তবেণী,সর্ব্বদেব করে পূজা।।উদর সমুদ্র, সশঙ্কিত রুদ্র,গম্ভীর উচ্চ শবদা।পর্ব্বত-কন্দর, সদৃশ খর্পর,সদাই আনন্দ-হ্রদা।।চিরদিন কৃষ্ণা, সাতিশয় তৃষ্ণা,সংগ্রাম শুনিয়া আইসে।দেখি কুতূহলে, হাসে খল খল,কম্পে সুরাসুর ত্রাসে।।সঙ্গে সহচর, ভূচর খেচর,ধেয়ে চতুর্দ্দিকে বেড়ে।ফেলি নরমুণ্ডে, তুলি ধরে তুণ্ডে,যেমন গেন্দুয়া পড়ে।।করতালি বাদ্যে, রণভূমি মধ্যে,নাচয়ে বিহ্বল মতি।কটিতে সুন্দর, ব্যাঘ্র-চর্ম্মম্বর,চরণে বিদরে ক্ষিতি।।ঘোর রণস্থলী, আথালি পাথালি,পড়িল তুরঙ্গ-সেনা।নদী বহে রক্তে, খরতর স্রোতে,পর্ব্বত সদৃশ ফেনা।।তুরঙ্গম সব, সদৃশ কচ্ছপ,কুম্ভীর মকর গজ।রথ সহ রথী, যেন যুথপতি,ভাসি যায় রথধ্বজ।।ছত্র হৈল পত্র, পুষ্প হৈল বস্ত্র,ভুজ কমলের দণ্ড।সদৃশ জলধি, তৃণ কাষ্ঠ আদি,ভাসে কর-পদ খণ্ড।।কাটা পদ কর, ছিন্ন কলেবর,শত শত ছত্র দণ্ড।দীঘল কুন্তল, শ্রবণে কুণ্ডল,ভাসি যায় নরমুণ্ড।।প্রলয় গম্ভীর, বহিছে রুধির,ক্রীড়য়ে কালীর গণ।কত উঠে ডুবে, ধরি আনি সবে,ভক্ষয়ে মেলি বদন।।খর্পর ভরিয়া, উদর পূরিয়া,করিয়া রুধির পান।অর্জ্জুনে কল্যাণ, করি নিজ স্থান,কালিকা কৈল প্রয়াণ।।ভারত-অমৃত, পিয়ে অনুব্রত,শ্রুতিযুগে সাধুজন।কালী-পদযুগে, কাশীদাস মাগে,দাসার্থে নন্দ-নন্দন।।৪৩. দুর্য্যোধনের মুকুটচ্ছেদন ওকুরুসৈন্যের নানা দুরবস্থাসৈন্য হৈতে বাহিরায় তবে পার্থ বীর।মেঘ হৈতে মুক্ত যেন হইল মিহির।।চতুর্দ্দিকে ভঙ্গীয়ান যত সেনাগণ।ভয়েতে কম্পিত সবে, শ্বাস ঘনে ঘন।।কেশ বাস মুক্ত সবে কম্পিত হৃদয়।পার্থে দেখি কৃতাঞ্জলি কহে সবিনয়।।আজ্ঞা কর, কি করিব কুন্তীর কুমার।পিতা পিতামহ সবে সেবক তোমার।।সেবক জনেরে ক্রোধ না হয় বিচার।রক্ষা কর লইলাম শরণ তোমর।।অর্জ্জুন কহেন, তোরা না করিস ভয়।যাহ নিজ স্থানে সবে নিঃশঙ্ক হৃদয়।।যুদ্ধেতে নিবৃত্ত আমি, বিনয়ী যে জন।তাহার নাহিক ভয় আমার সদন।।তবে কতদূরে থাকি দেখেন অর্জ্জুন।চৈতন্য পাইল কতক্ষণে কুরুগণ।।একজন-মুখ আর জন নাহি চায়।লজ্জায় যতেক বীর হৈল মৃতপ্রায়।।কার শিরে নাহি পাগ, কার শিরে বাস।লাজে মুখ তুলি কেহ নাহি কহে ভাষ।।দূরে থাকি ধনঞ্জয় মারে দশ বাণ।গুরু-বৃদ্ধ-পদরজে করিতে প্রণাম।।অর্দ্ধচন্দ্র বাণ তবে মারেন কিরীটি।দুর্য্যোধনের মুকুট পাড়িলেন কাটি।।ভয়েতে আচ্ছন্ন রাজা চারিদিকে চায়।সবাকার মধ্যে গিয়া আপনি লুকায়।।দ্রোণাচার্য্য বলেন, না কর আর ভয়।বড় ক্ষমাশীল হয় কুন্তীর তনয়।।তোমারে অর্জ্জুন যদি নিশ্চয় মারিবে।মস্তক থাকিতে কেন মুকুট কাটিবে।।বিশেষে নৃপতি ধর্ম্ম দয়া তোমা করে।তাঁর আজ্ঞা বিনা পার্থ মানিতে না পারে।।সে হেতু ক্ষমিল তোমা, করি অনুমান।বৃকোদর হৈলে নিত সবাকার প্রাণ।।চল চল হেথা হৈতে, বিলম্ব না সয়।মনে হয় বৃকোদর আসিবে ত্বরায়।।হেনকালে বলিতেছে শকুনি-সারথি।রথেতে মাতুল তব নাহি নরপতি।।শুনি, কহে দুর্য্যোধন বিষণ্ণ বদন।রথেতে মাতুল নাহি দেখি কি কারণ।।কেহ বলে, তারে ক্রোধ অনেক আছিল।বান্ধিয়া অর্জ্জুন বুঝি সঙ্গে লয়ে গেল।।কেহ বলে, যুদ্ধে কিবা পড়িল শকুনি।কেহ বলে, আগু পলাইল হেন জানি।।রাজা বলে, মাতুলেরে খুঁজ, কোথা গেল।আজ্ঞামাত্র চতুর্দ্দিকে সবাই ধাইল।।অনেক ভ্রমই করি সবে চতুর্ভিত।রজকের ঘরে দেখে শকুনি ব্যথিত।।গর্দ্দভের পৃষ্ঠে বান্ধিয়াছে হাতে পায়।ডাক দিয়া বলে মোর প্রাণ বাহিরায়।।মুক্ত করি শকুনিরে নিল সেইক্ষণ।নৃপতিরে কহে গিয়া সব বিবরণ।।শকুনির দুরবস্থা সভামধ্যে দেখি।কেহ হাসে, কেহ কান্দে, কেহ ঠারে আঁখি।।সহসা সুশর্ম্মা রাজা আসি উপনীত।আপনা হৈতে দেখে রাজাকে দুঃখিত।।কহিতে লাগিল তবে করিয়া বিনয়।চল শীঘ্র নরপতি, দেরী নাহি সয়।।বিরাট রাজারে আমি আনিনু বান্ধিয়া।অনেক করিল যুদ্ধ গন্ধর্ব্ব আসিয়া।।সর্ব্ব সৈন্য পলাইল গন্ধর্ব্বের ত্রাসে।একাকী পাইয়া মোরে ধরিলেক কেশে।।বড় ধর্ম্মশীল রাজ-সভাসদ্ কঙ্ক।দয়া করি আমারে সে করিল নিঃশঙ্ক।।সে গন্ধর্ব্ব যদি রাজা এখানে আসিবে।মুহূর্ত্তেকে সর্ব্ব সৈন্য নিপাত করিবে।।কোথা আছে দুর্য্যোধন কর্ণ দুঃশাসন।এইমাত্র শুনি রাজা তাহার বচন।।গজ শুণ্ডে ধরি তুলি অন্য গজে মারে।তুরঙ্গে তুরঙ্গ, রথ রথেতে প্রহারে।।অতি বিপরীত কর্ম্ম দেখি লাগে ভয়।আসিতে পারয়ে হেথা, হেন মনে লয়।।কৃপাচার্য্য বলিল, এ কিছু অন্য নয়।কীচকে মারিয়া কৈল গন্ধর্ব্ব-আলয়।।ভীষ্ম বলে, সুশর্ম্মা যে কহে সত্য কথা।তিল এক রহিতে না হয় যুক্তি হেথা।।গন্ধর্ব্ব না হয় সেই বীর বৃকোদর।আসিলে সে জন ভাল নহে নৃপবর।।যে কর্ম্ম করিল আজি বীর ধনঞ্জয়।দয়া করি না মারিল সদয় হৃদয়।।ভীমসেন সঙ্গে যদি থাকিত ইহার।আজিকার মধ্যে হৈত সবার সংহার।।নির্দ্দয় নিষ্ঠুর বড় কঠিন হৃদয়।পলাইয়া গেলে গোড়াইয়া প্রাণ লয়।।শরণ লইলে সেইক্ষণে প্রাণ হরে।চল চল শীঘ্র, সেই আসিবারে পারে।।এত বলি যে যাহার চড়িয়া বাহনে।হস্তিনা নগরে সবে গেল দুঃখমনে।।আকাশে অমরবৃন্দ অদ্ভুত দেখিয়া।নিজ নিজ স্থানে যান পার্থে বাখানিয়া।।৪৪. শমীবৃক্ষতলে অর্জ্জুনের পূর্ব্ববেশ ধারণতবে শমীবৃক্ষতলে গেলেন অর্জ্জুন।পূর্ব্ববৎ বান্ধি রাখে সব ধনুর্গুণ।।দুই করে শঙ্খ দিয়া শ্রবণে কুণ্ডল।কিরীট রাখিয়া বেণী করেন কুন্তল।।হনূমন্ত-ধ্বজ গেল আকাশেতে চলি।সারথি হইয়া পার্থ নিল কড়িয়ালী।।উত্তরে চাহিয়া তবে বলে ধনঞ্জয়।তব সভামধ্যে পঞ্চ পাণ্ডব আছয়।।লোকে যেন নাহি জানে, এ সব বচন।পিতার অগ্রেতে এই কহিবে কথন।।বাহুবলে জিনিলাম সব কুরুগণ।ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ সহ দুর্য্যোধন।।পিতার সম্মান হবে, লোকেতে পৌরুষ।রাজ্যে যত লোক তব ঘুষিবেক যশ।।উত্তর বলিল, ইহা কিমতে হইবে।কহিলে কি লোকে ইহা প্রত্যয় করিবে।।যে কর্ম্ম করিলে তুমি আজকার রণে।তোমা বিনা করে হেন নাহি ত্রিভুবনে।।আমি করিলাম, ইহা কহিব স্বমুখে।পশ্চাতে হইলে ব্যক্ত হাসিবেক লোকে।।প্রকার করিয়া আমি কহিব পিতারে।প্রকাশ পর্য্যন্ত কেহ না জানে তোমারে।।তবে পার্থ কহিলেন, যাব সন্ধ্যাকালে।জয়বার্ত্তা দেহ এক পাঠায়ে গোপালে।রণজয় বার্ত্তা তব দিবে অন্তুঃপুরে।তব হেতু আছে সবে চিন্তিত অন্তরে।।উত্তর দূতেরে তবে করেন প্রেরণ।দ্রুতগতি দূত পুরে চলিল তখন।।মহাভারতের কথা বর্ণিতে কে পারে।যেন ভেলা বান্ধি চাহে সিন্ধু তরিবারে।।শ্রুত মাত্র কহি আমি রচিয়া পয়ার।সাধুজন চরণেতে বিনয় আমার।।সাধুলোক গুণকথা সর্ব্বলোকে কয়।গুণ বিনা অপগুণ সাধু নাহি লয়।অতএব করি আশা, মোরে সাধুজনে।মূর্খ জন জানি ক্ষমা দিবে নিজগুণে।।কাশীরাম দাস কহে সাধুজন পায়।পাইব পরম পদ যাঁহার কৃপায়।।৪৫. বিরাট রাজার স্বগৃহে আগমন ওযুধিষ্ঠিরের সহিত পাশা-ক্রীড়াহেথায় বিরাট রাজা ত্রিগর্ত্তে জিনিয়া।বাদ্য কোলাহলে দেশে উত্তরিল গিয়া।।অন্তঃপুরে প্রবেশিল বিরাট ভূপতি।আগুসারি নিল আসি যতেক যুবতী।।একে একে প্রণমিল যত কন্যাগণ।উত্তর না দেখি রাজা বলিছে বচন।।কি কারণে নাহি দেখি কুমার উত্তর।রাণী বলে বার্ত্তা নাহি জান নরবর।।তুমি গেলে ত্রিগর্ত্তের যুদ্ধেতে যখন।উত্তরে কৌরব আসি বেড়িল গোধন।।গোপেরা আসিয়া তবে দিল সমাচার।শুনি যুদ্ধে চলি গেল উত্তর কুমার।।দ্বিতীয় নাহিক রথী, সারথি না ছিল।সারথি করিয়া বৃহন্নলা পুত্র গেল।।ইহা শুনি নরপতি শিরে হানে ঘাত।বিস্ময় মানিয়া চিন্তে মুখে দিয়া হাত।।এমত কুবুদ্ধি কেন পুত্রের হইল।কুরুসৈন্য মধ্যে পুত্র একা রণে গেল।।যেই সৈন্যে ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ দুর্য্যোধন।ইন্দ্র জিনিবারে পারে এক এক জন।।হেন সৈন্যমধ্যে যুদ্ধ করিবে একক।তাহাতে সারথি বৃহন্নলা নপুংসক।।এহেতু আমার চিত্তে হইতেছে ত্রাস।বৃহন্নলা কৈল যাত্রা, লোকে উপহাস।।যত যোদ্ধাগণ সবে যাহ শীঘ্রগতি।হয় হস্তী রথী মম যতেক সারথি।।এতক্ষণ জীয়ে, কি না জীয়ে, নাহি জানি।শীঘ্র শুভবার্ত্তা মোরে পাঠাবেক শুনি।।এতেক বচন রাজা বলে বার বার।শুনিয়া উত্তর দিল ধর্ম্মের কুমার।।চিন্তা না করহ রাজা উত্তরের প্রতি।মহাবুদ্ধি বৃহন্নলা আছয়ে সারথি।।যদি সাথে আনে দেব ইন্দ্রাদি কৌরব।বৃহন্নলা সারথির নাহি পরাভব।।এইরূপে বিরাটেরে কহে ধর্ম্মসুত।হেনকালে উপনীত উত্তরের দূত।।প্রণমিয়া নৃপবরে বলে যোড় করে।উত্তম কুমার রাজা পাঠাইল মোরে।।কুরুসৈন্য জিনিয়া গোধন ছাড়াইল।রণে ভঙ্গ দিয়া কুরুগণ পলাইল।।আসিছে সারথি সহ কুমার উত্তর।মোরে পাঠাইয়া দিল জয় সমাচার।।শুনিয়া আনন্দে মোহে বিরাট নৃপতি।ধর্ম্মপুত্র তবে কহিছেন তাঁর প্রতি।।বড় ভাগ্যে নৃপ শুভ বৃত্তান্ত শুনিলে।তব পুত্র কুরুসৈন্য জিনিলেক হেলে।।পূর্ব্বে কহিয়াছি, বৃহন্নলা আছে যথা।কৌরবে জিনিবে ইহা বিচিত্র কি কথা।।তবে রাজা আজ্ঞা দিল মন্ত্রিগণ প্রতি।দূতগণে পুরস্কার কর শীগ্রগতি।।কুলের দীপক মম কুমার উত্তর।কুরুসৈন্য যুদ্ধে আজি জিনে একেশ্বর।।তার আসিবার পথ কর মনোহর।উচ্চ নীচ কাটি সব কর সমসর।।দিব্য দিব্য গন্ধ-বৃক্ষ রোপহ দুসারি।মঙ্গল বাজনা কর নাচুক নরনারী।।যতেক কুমার যাহ সুসজ্জ হইয়া।আগুবাড়ি উত্তরেরে আন সবে গিয়া।।উত্তরাদি কন্যা যত যাহ শীঘ্রতর।বৃহন্নলে আন সবে করিয়া আদর।।এতেক রাজার আজ্ঞা পেয়ে মন্ত্রিগণ।নৃপ-আজ্ঞা মত কাজ করিল তখন।।হৃষ্ট হয়ে বলে রাজা চাহি ধর্ম্মকারী।খেলিব সম্প্রতি, শীঘ্র আন পাশা-সারি।।ধর্ম্ম বলিলেন, রাজা নহে এ সময়।হর্ষকালে পাশাতে যে চিত্ত স্থির নয়।।বিশেষে দেবন ভাল নহে অনুক্ষণ।সর্ব্বকার্য্য নষ্ট হয় পাশার কারণ।।লক্ষ্মী ভ্রষ্ট, রাজ্য নষ্ট, শত্রু হয় বলী।নানামত দুঃখ লোক পায় পামা খেলি।।শুনিয়াছ তুমি পাণ্ডবের বিবরণ।এই পাশা হেতু হারাইল রাজ্য ধন।।বিরাট কহিল কঙ্ক, কহ না বুঝিয়া।কোন্ শত্রু আছে মম বিরোধে আসিয়া।।রাজচক্রবর্ত্তী কুরুরাজ দুর্য্যোধন।হেন জনে জিনিলেক আমার নন্দন।।ভুবন মণ্ডলে এই শব্দ প্রচারিল।পৃথিবীর রাজা শুনি ভয়ে স্তব্ধ হৈল।।আর কোন্ জন আছে পৃথিবী ভিতরে।হইয়া আমার বৈরী যাবে যমঘরে।।যুধিষ্ঠির বলে, রাজা উত্তম কহিলা।কি ভয় কৌরবে, যার আছে বৃহন্নলা।।এত শুনি রোষভরে বিরাট নৃপতি।দুই চক্ষু রক্তবর্ণ কহে কঙ্ক প্রতি।।কুলের তিলক মম কুমার উত্তর।সংগ্রামে জিনিল সেই কুরু-নরবর।।একবার তার তুই না কহিস্ গুণ।বৃহন্নলা ক্লীবে বাখানিস্ পুনঃ পুনঃ।।কোন্ ছার বৃহন্নলা বাখানিস্ তারে।তার মত কত জন আছে মম পুরে।।কেবল সহায় মাত্র হইল সংগ্রামে।কোন্ গুণে ধন্যবাদ দিস্ নরাধমে।।শ্রবণে শুনিতে যোগ্য যেই কথা নহে।পুনঃ পুনঃ কহিছিস্ , কত দেহে সহে।।মম কথা কঙ্ক নাহি শুন ভালমতে।কিমতে এ ভাষা কহ আমার অগ্রেতে।।কহিতে কহিতে রাজা হৈল ক্রোধমতি।হাতেতে আছিল পাশা, মারে শীগ্রগতি।।অক্ষপাটী প্রহারিল রাজার বদনে।ফুটিয়া শোণিত বাহিরায় সেইক্ষণে।।অক্রোধী অজাতশত্রু ধর্ম্মের নন্দন।দুই হাতে নিজ রক্ত ধরেন তখন।।নিকটে আছিলা কৃষ্ণা বুঝি অভিপ্রায়।হেমপাত্র শীঘ্র লয়ে রাজারে যোগায়।।সেই পাত্র করি রাজা ধরেন শোণিতে।না দিলেন তাহা যত্নে ভূমিতে পড়িতে।।হেনকালে দ্বারদেশে উত্তর আগত।দ্বারীরে বলিল, নৃপে জানও ত্বরিত।।উত্তরের আজ্ঞা পেয়ে দ্বারী শীঘ্রগতি।করযোড়ে বার্ত্তা কহে মৎস্যরাজ প্রতি।।অবধান নরপতি শুভ সমাচার।বৃহন্নলা সহ এল উত্তর কুমার।।তব আজ্ঞা হেতু রাজা আছয়ে দুয়ারে।আজ্ঞা হৈলে ভেটিবেন আসিয়া তোমারে।।বার্ত্তা পেয়ে নরপতি কহে হরষেতে।বৃহন্নলা সহ পুত্রে আনহ ত্বরিতে।।বিরাটের আজ্ঞা পেয়ে চলিল সারথি।নিকটে ডাকিল তারে ধর্ম্ম নরপতি।।নিঃশব্দে কহেন রাজা সারথির কাণে।শীঘ্র গিয়া আন তুমি রাজার নন্দনে।।বৃহন্নলা হেথায় না আন কদাচন।সাবধানে কহিবে না হও বিস্মরণ।।সারথি শুনিয়া তবে চলে সেইক্ষণে।কুমারে বলিল, চল রাজ-সম্ভাষণে।।বৃহন্নলা এবে যাক আপনার স্থানে।একেশ্বর চল তুমি রাজ-সম্ভাষণে।।বৃহন্নলা যাইবারে কঙ্কের বারণ।শুনিয়া করেন পার্থ স্বস্থানে গমন।।উত্তরে লইয়া দ্বারী গেল সেইক্ষণ।বাপে নমস্করি চাহে ধর্ম্মের বদন।।রক্তধারা বহে মুখে, দেখিয়া কুমার।সম্ভ্রমে বাপেরে বলে হয়ে চমৎকার।।কহ তাত কেন দেখি হেন বিপরীত।ভূমিতে বসিয়া কঙ্ক কেন বিষাদিত।।মুখে রক্তধারা বহিতেছে কি কারণ।কিবা হেতু কহ তাত হইল এমন।।মৎস্যরাজ বলে, পুত্র গুনহ কারণ।তোমার প্রশংসা কঙ্ক করি অবহেলা।।পুনঃ পুনঃ বলে ধন্য ক্লীব বৃহন্নলা।এই হেতু চিত্তে ক্রোধ হৈল মম তাত।অক্ষপাটী প্রহারিনু, হৈল রক্তপাত।।উত্তর বলিল, তাত কুকর্ম্ম করিলে।সামান্য ব্রাহ্মণ বলি কঙ্কেরে জানিলে।।এক্ষণে ইহারে যদি শান্ত না করিবে।নিশ্চিত জানিহ তাত সর্ব্বনাশ হবে।।ইন্দ্র যম বৈরী হৈলে আছে প্রতিকার।কঙ্ক ক্রোধ হৈলে রক্ষা নাহিক তাহার।।শীঘ্র উঠ তাত, আগে প্রবোধ কঙ্কেরে।যেমত চিত্তেতে ক্রোধ না জন্মে তোমারে।।পুত্রের বচনে রাজা উঠি শীঘ্রগতি।বিনয় পূর্ব্বক কহে ধর্ম্মরাজ প্রতি।।অনেক স্তবন রাজা করিল কঙ্কেরে।অত্যন্ত অজ্ঞান আমি ক্ষমহ আমারে।।ধর্ম্ম বলিলেন, ব্যস্ত না হও রাজন।তোমাতে আমার ক্রোধ নাহি কদাচন।।আমার হইলে ক্রোধ পূর্ব্বেতে হইত।এখন তোমাতে ক্রোধ নাহি কদাচিত।।পূর্ব্বেতে তোমারে ক্ষমা করেছি রাজন।অক্ষপাটী যেই কালে করিলে যাতন।।আমার ললাটে যেই শোণিত বহিল।যতন পূর্ব্বক রক্ত পাত্রে ধরা গেল।।শোণিত যদ্যপি সেই পড়িত ভূতলে।তবে রাজ্য সহ নাহি থাকিতে কুশলে।।আমার শোণিত বিন্দু যেই স্থলে পড়ে।সেই স্থলের রাজা প্রজা সকলেই মরে।।উত্তর বলিল, তাত কঙ্ক দয়াবান।কঙ্কের ক্ষমাতে হৈল সবার কল্যাণ।।যখন সারথি মোরে আনিবারে গেল।বৃহন্নলা আসিবারে কঙ্ক নিষেধিল।।বৃহন্নলা আসি যদি শোণিত দেখিত।তবে সে জনক বড় অনর্থ ঘটিত।।মহাভারতের কথা অমৃত-অর্ণব।যাহার প্রসাদে জীব তরে ভবার্ণব।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon